ইস্যুটির ওভারভিউ
তিনটি কোম্পানি—সেঞ্চুরি ফুড প্রোডাক্টস, ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্স এবং মুরাদ এন্টারপ্রাইজ—ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রাম শাখার গ্রাহক। জুলাইয়ের শেষ নাগাদ এসব কোম্পানির কাছে সম্মিলিতভাবে ব্যাংকের পাওনা ছিল ৩ হাজার ১২৫ কোটি টাকা।এই ঋণগুলির সাথে যুক্ত ঠিকানাগুলি আবাসিক ভবন এবং ছোট দোকান বলে পাওয়া গেছে, যা ঋণের বৈধতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
সন্দেহজনক ঋণ এবং জাল কোম্পানি
টপটেন ট্রেডিং নামে একটি কোম্পানিকে ৫৪৮ কোটি টাকার আরেকটি ঋণ দেওয়া হয়েছিল, যেটি ঢাকার গোপীবাগের একটি ঠিকানায় নিবন্ধিত। যেখানে শুধুমাত্র একটি বাস কাউন্টার রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বহুল সমালোচিত এস আলম গ্রুপ ভুয়া নাম ও ঠিকানা ব্যবহার করে ইসলামী ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নথিপত্রের মাঠপর্যায়ের তদন্ত ও পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে এস আলম গ্রুপ ব্যাংক থেকে অন্তত ৭৫,০০০ কোটি টাকা পাচার করেছে।
ঋণের বিবরণ
গতকাল পর্যন্ত, ইসলামী ব্যাংকের মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১.৫ লাখ কোটি টাকা, যার মোট আমানতের পরিমাণ ১,৫৩,২৭৪ কোটি টাকা। এস আলম গ্রুপের জন্য দায়ী ৭৪,৯৭২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের অর্ধেক। গ্রুপটি তাদের সাতটি কোম্পানির নামে সরাসরি ১৪,৪২৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।
তাছাড়া, এসআইবিএল-এর চেয়ারম্যান এস আলমের জামাইয়ের মালিকানাধীন দুটি কোম্পানির নামে ৪৫৫ কোটি টাকা ধার নেওয়া হয়েছিল এবং আরও ১৫,০০০ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছিল নাবিল গ্রুপের নামে। জাল কোম্পানির নামে, জাল জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল নম্বর এবং অন্যান্য নথি ব্যবহার করে অনেক ঋণ দেওয়া হয়েছিল।
উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের ভূমিকা
এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদ এই বিপুল ঋণ আদায়ের জন্য একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তদন্তে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই সাবেক গভর্নর ফজলে কবির এবং আবদুর রউফ তালুকদার সহ আরও কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মাসুদকে সহায়তা করেছিলেন। ৫ আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর বিক্ষোভ শুরু হয়, যার ফলে গভর্নর রউফ তালুকদার পদত্যাগ করেন এবং অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা যারা জড়িত ছিলেন তাদের প্রস্থান করার জন্য।
ব্যাংকিং আইন লঙ্ঘন
ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, একটি ব্যাংক একটি একক গ্রুপকে তার মূলধনের সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দিতে পারে। জুন পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের মূলধন ছিল ১০,৬৪৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকটি যেকোনো গ্রুপকে সর্বোচ্চ ২,৬৬১ কোটি টাকা ঋণ দিতে পারে। অনুমোদনযোগ্য পরিমাণের বাইরে ঋণ মঞ্জুর করে এই সীমা চরমভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছিল।
ঋণের বিস্তারিত ভাঙ্গন
এস আলম গ্রুপের ওয়েবসাইটে তালিকাভুক্ত সাতটি কোম্পানির নামে প্রাথমিকভাবে ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখার মাধ্যমে মোট ১৪ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
– এস আলম রিফাইন সুগার ইন্ডাস্ট্রির নামে ৩,৬০৯ কোটি টাকা
– চেমন ইস্পাতের নামে ৩,৩৩৮ কোটি টাকা
– এস আলম সুপার এডিবল অয়েলের নামে ৩,২৩২ কোটি টাকা
– ইনফিনিট স্টিপ ইন্ডাস্ট্রিজের নামে ২,২৮১ কোটি টাকা
– এস আলম ভেজিটেবল অয়েলের নামে ১,৫৫১ কোটি টাকা
– গ্লোবাল ট্রেডিং কর্পোরেশনের নামে ৯৭৫ কোটি টাকা
– এস আলম স্টিলের নামে ৭০ কোটি টাকা
ইসলামী ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের ১.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ রয়েছে, যার ১৫০ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৮,০০০ কোটি টাকা) এস আলম গ্রুপকে ঋণ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও, এস আলমের জামাইয়ের সাথে যুক্ত কোম্পানি দুটি ইউনিটেক্স কম্পোজিট মিলকে ২১৫ কোটি টাকা এবং ইউনিটেক্স এলপি গ্যাসকে ২৪০ কোটি টাকা ধার দেওয়া হয়েছিল।
প্রতারণামূলক অনুশীলন এবং ছদ্মবেশী ঋণ
ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন যে এই ঋণগুলো বিভিন্ন নামে জারি করা হলেও কার্যকরভাবে এস আলম গ্রুপের জন্য বেনামি (ছদ্মবেশী) ঋণ। উদাহরণস্বরূপ, চট্টগ্রামের মাসুদ প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রি ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে ১৯,৬০৩ কোটি টাকা উত্তোলনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল, যদিও কোম্পানির মালিক ব্যাংকের সাথে কোনও ঋণ থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।
নকল কোম্পানির সম্পৃক্ততা
এস আলম গ্রুপ অন্যান্য নকল কোম্পানির নামেও বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:
– আনোয়ারা ফিড মিলের নামে ১,২৬৮ কোটি টাকা
– মেডিগ্রিন ইন্টারন্যাশনালের নামে ১,১৬২ কোটি টাকা
– মার্টস বিজনেসের নামে ১,১৫৮ কোটি টাকা
– এজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে ১,১৪৪ কোটি টাকা
– ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্সের নামে ১,১১৪ কোটি টাকা
– মুরাদ এন্টারপ্রাইজের নামে ১,৯২০ কোটি টাকা
এস আলম গ্রুপের প্রধান, সাইফুল আলম মাসুদের মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা যায়নি এবং ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মাওলা কলে সাড়া দেননি। চলমান বিক্ষোভের আলোকে, ব্যাংকের উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডাররা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে একটি চিঠি পাঠিয়ে বোর্ড পুনর্গঠনের দাবিতে এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ উত্তোলনের অভিযোগ করেছেন।
অন-দ্য-গ্রাউন্ড তদন্ত থেকে পাওয়া তথ্য
এসব ঋণের সাথে যুক্ত বিভিন্ন ঠিকানায় অনুসন্ধানে জানা গেছে যে এগুলোর অনেকগুলো হয় জাল বা অস্তিত্বহীন। উদাহরণস্বরূপ, টপটেন ট্রেডিং হাউস একটি গোপীবাগ ঠিকানায় নিবন্ধিত যা একটি বাস কাউন্টার ছাড়া আর কিছুই নয়। একইভাবে, ঠিকানা ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্স এবং মুরাদ এন্টারপ্রাইজের জন্য দেওয়া এসএসও জাল পাওয়া গেছে।
নাবিল গ্রুপের মামলা
এস আলম গ্রুপের পণ্যের ডিলার নাবিল গ্রুপও এই কেলেঙ্কারিতে জড়িত। জুলাইয়ের শেষ নাগাদ নাবিল গ্রুপ বিভিন্ন ঠিকানা ব্যবহার করে ইসলামী ব্যাংক থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে অনেক ঋণই শেষ পর্যন্ত এস আলম গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও কারসাজি
এস আলম গ্রুপ ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের দখল নেওয়ার পর, এই প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের সুবিধার্থে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কাঠামোতে হেরফের করা হয়েছিল। এস আলমের অনুগতদের সাথে মূল কর্মীদের স্থলাভিষিক্ত করা হয়, যারা ঢাকা ও চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ও শাখা নিয়ন্ত্রণ করতেন। এই কর্মকর্তাদের কাছে সংবেদনশীল তথ্য ছিল এবং তারা ঋণ জালিয়াতি চালাতে সহায়ক ছিল।
ইসলামী ব্যাংকের উপর এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ
এস আলম গ্রুপ শুধুমাত্র ঋণ জালিয়াতিই করেনি বরং ২৪টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকের ৮২ শতাংশ শেয়ারের মালিক হয়ে ব্যাংক কোম্পানি আইন লঙ্ঘন করেছে, যা ১০ শতাংশের আইনি সীমা অতিক্রম করেছে। এই শেয়ারগুলি ব্যাংকের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করে গ্রুপের সাথে যুক্ত বিভিন্ন কোম্পানিতে বিতরণ করা হয়েছিল।
উপসংহার
ইসলামী ব্যাংক এবং এস আলম গ্রুপের সাথে জড়িত জালিয়াতি ও দুর্নীতির মাত্রা ব্যাপক, হাজার হাজার কোটি টাকা জড়িত। তদন্ত ভবিষ্যতে এই ধরনের বড় মাপের আর্থিক অসদাচরণ রোধ করতে কঠোর তত্ত্বাবধান এবং সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
Read More: ঢাকায় রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সাবেক আইনমন্ত্রী ও উপদেষ্টা গ্রেফতার
Read More: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চলমান আন্দোলনের ভুল প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে